শত মৃত্যু হাজারো পঙ্গুত্ব ছাপিয়ে ‘শ্যালোর গাড়ি’ কুষ্টিয়ায় পথের রাজা

- আপডেট সময় : ০২:৪৭:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫ ২২ বার পড়া হয়েছে
শ্যালোর গাড়ির দৌরাত্ম্যে সড়কে লাশের সংখ্যা উদ্বেগজনক। গুরুতর আহতাবস্থায় পঙ্গুত্ব সঙ্গী করে জীবনযাপনের মিছিলও বড়। অদ্ভুতুড়ে এই গাড়ির কোনো প্রকৌশলগত ব্যাখ্যা নেই, গাড়ি চালকের চালানোর প্রশিক্ষণ তো দূরের কথা, সড়কে চলার নিয়মকানুনই জানা নেই। এগুলো ব্যবহার হয় শুধুমাত্র মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের দুষ্টু চক্রে। নিয়ন্ত্রণ নেই সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের। গল্পের এই সূচনা প্রেক্ষাপট কুষ্টিয়া জেলার সর্বাঙ্গে।
১৯৫০ সালে কৃষি জমিতে সেচ কাজের জন্য এই ভূখণ্ডে প্রথম জাপান থেকে আমদানি হয় শ্যালো ইঞ্জিন। এরপর নদীমাতৃক বাংলাদেশে সেচ কাজের পাশাপাশি বৈঠা বেয়ে চলা নৌকায় সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে শ্যালো ইঞ্জিন পায় তৃতীয় মাত্রা। ততদিনে বিভিন্ন দেশীয় ইঞ্জিন এদেশে প্রবেশ করেছে। তিনচাকার পায়ে চলা ভ্যানগাড়ির খানেকটা রূপ বদলে শ্যালো ইঞ্জিন যোগ করে গ্রামের পথে নামে অদ্ভুত এক গাড়ি। যাতায়াত ব্যবস্থায় সময় কমে যাওয়ায় ঝুঁকি জেনেও মানুষ ব্যবহার শুরু করে, তবে তার হার ছিলো খুবই কম।
শ্যালো ইঞ্জিনের ওপর নানা কাঠামো বসিয়ে দিনে দিনে রকমারি গাড়ি ওঠে সড়কে। নছিমন, করিমন, ভটভটি, স্টেয়ারিং, লাটাহাম্বা’র মতো অদ্ভুত নাম নিয়ে সড়ক মহাসড়ক ক্রমেই দখলে নেয়া শুরু করে শ্যালোর গাড়ি। শুরুর দিকে মানুষ যানবাহন হিসাবে ব্যবহার করলেও ভয়াবহ প্রাণঘাতি সব উদাহরণ তৈরির কারণে গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় গণমানুষ। পরের গল্পটা চলতি দু’দশকের।
কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় অন্তত হাজার তিনেক শ্যালোর গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে ‘স্টেয়ারিং’ নামে। বাকি দু’হাজারের মতো অন্যান্য নাম ও কাঠামোয়। প্রতিদিন বাইরে থেকে প্রবেশ করা গাড়ির সংখ্যা আরও অন্তত হাজার খানেক। অর্থাৎ, ছ’হাজারের মতো শ্যালোর গাড়ি প্রতিনিয়ত চলছে জেলার সবধরনের সড়ক-মহাসড়কে। সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা না হয়ে মিমাংসা হওয়ায় শ্যালোর গাড়িতে দুর্ঘটনায় হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রতিবছর প্রকাশিত খবর থেকে সংগৃহীত তথ্য বলছে, জেলায় ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার অন্তত ৭০ ভাগ শ্যালোর গাড়ি সংশ্লিষ্ট। উদ্বেগজনক তথ্য হলো কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যার অন্তত ৬০ ভাগ শ্যালোর গাড়ি সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা থেকে। বাকি ৪০ ভাগের অধিকাংশ ড্রাম ট্রাকের দখলে, ভয়াবহতার তালিকায় আছে দ্রুতগতির মোটরসাইকেল এবং অপ্রশিক্ষিত চালকের ইজিবাইক। শ্যালোর গাড়ির দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের খবর এ জেলায় নিত্যদিনের।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এধরণের ইঞ্জিনে তৈরি গাড়ি প্রকৌশল অনুমোদন সাপেক্ষে শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেতে বা ফসলের মাঠে চললেও বাংলাদেশে এর বেশিরভাগ ব্যবহার ছয় ধরণের কাজে হয়ে আসছে; যার সবই জনতার সড়কে। মোটা পুঁজির ব্যবসায়ী আড়ৎদার বা মজুদদার কিংবা পাইকারের নানা পণ্য পরিবহন, গবাদিপশু পরিবহন, বড় বরাদ্দের নির্মাণ কাজে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন, নদী থেকে বৈধ-অবৈধ ভাবে উত্তোলত বালু ক্রয়-বিক্রয়, বৈধ-অবৈধ ইট ভাটায় মাটি সরবরাহ, নিয়মবহির্ভূত ভাবে কৃষি জমির পৃষ্ঠ কেটে বিক্রি করা মাটি পরিবহন। পক্ষান্তরে এধরণের পণ্য পরিবহনের জন্য রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত বৈধ-নিরাপদ নানা পরিবহন দেশেই প্রচলিত রয়েছে। সেসব গাড়ি ব্যবহারেও চালক-সহযোগী ও শ্রমজীবী মিলে কর্মসংস্থানের ভারসাম্য সৃষ্টি থাকে।
সড়কে নৃশংস মৃত্যুর কারিগর শ্যালোর গাড়ি আদৌও অর্থনীতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখছে কি-না জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর কাজী মোস্তফা আরিফ মন্তব্য জানান, কুষ্টিয়া ও আশপাশের জেলাগুলোতে এ যেন অদ্ভুত এক শিল্প গড়ে উঠেছে! শ্যালো ইঞ্জিনের এসমস্ত গাড়ি অর্থনীতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখার নূন্যতম সম্ভাবনা নেই। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি , শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও দুর্ঘটনার মতো ঘটনায় অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি চরমে। শ্রমিক ও জনসাধারণ নিয়মিত ক্ষতির মুখে থাকলেও সুবিধাভোগী শ্রেণীর লাভের সূচক উর্ধ্বমুখী থাকছে, কাজ ভিত্তিক মজুরি পাচ্ছেন না শ্রমিক। এসব কারণেই এই বিস্তার।
শ্রমিকের কর্মসংস্থান হারানোর সম্ভাবনা নেই, পাশাপাশি বৈধ বাহন চললে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, এসব অবৈধ যানবাহনের বিকল্প ভাবা উচিত বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সাধারণ দৃষ্টিতে দেখতে অদ্ভুত এইসব গাড়ি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কতটা যৌক্তিক তা-ও জানার চেষ্টা করা হলে পাওয়া যায় ভয়াবহ সব তথ্য। মেকানিক্যাল টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ ডক্টর বিপুল কুমার কুণ্ড জানান, লোহালক্কড় ব্যবহার করে গড়িয়ে দিতে পারলেই গাড়ি হবে না। এসব গাড়ির প্রকৌশলগত কোনো উপযুক্ত ব্যখ্যা নেই। এগুলো বিপদজনক এবং সড়কে দুর্ঘটনা তরান্বিত করছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক পাওয়ার টেকনোলোজি গবেষক জানান, এসব গাড়ির মূল সমস্যা ব্রেইকিং সিস্টেমে। ব্রেইকিং সিস্টেম অনুপযুক্ত হওয়ায় দুর্ঘটনাপ্রবণ। চালকের প্রশিক্ষণও নেই। গাড়িগুলো প্রকৌশলগত দিক থেকে মডিফাই করে, চালকদের প্রশিক্ষিত করে চালানো যেতে পারে। নতুবা এটি ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা শ্যালোর গাড়ির বেশ কয়েকজন চালক শ্রমিকের সাথে কথা বলে জেনেছি। এই গাড়ির ইঞ্জিনের বিকট শব্দে চালকের আসনে বসে চলতি অবস্থায় আশপাশের কোন হর্ণ বা চিৎকার শোনা সম্ভব নয়। ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগের ওপরে থাকলে ব্রেক করে গাড়ি থামাতে বেশ খানেক ক্ষণ সময় ও দীর্ঘ জায়গা প্রয়োজন, যা ব্যস্ত সড়কে প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি, ডানে বায়ে গাড়ি ঘোরার যে পদ্ধতি তাতেও মাপজোখের অনিশ্চয়তা রয়েছে। চালক ও সহযোগীর আসনে সার্বক্ষণিক অসহনীয় ঝাঁকুনি থাকে। ঝুঁকি জেনেও তারা এ কাজে আছে জীবীকার প্রয়োজনে।
এবার আসা যাক সড়কের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা এসব অদ্ভুত গাড়িকে কিভাবে দেখছেন, সেই প্রসঙ্গে। কুষ্টিয়া ট্রাফিক বিভাগে বর্তমান দায়িত্বরত, পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন), টিআই (প্রশাসন) শেখ শাহাদাত আলী বলেন, সড়ক-মহাসড়কে এসব গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিয়মিত অভিযানে আমরা জরিমানা করছি। জেলা প্রশাসকের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এসব গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-দৌলতপুর-মিরপুর সহ সকল উপজেলায় ইট ভাটার প্রয়োজনে ফসলের ক্ষেত থেকে মাটি কেটে পরিবহন ও ইট পরিবহনের জন্য ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে শ্যালোর গাড়ি। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় ইট ভাটা ও মাটি কাটার রমরমা আসর বসছে ইফতারের পর থেকে সেহেরি পর্যন্ত। বেআইনী ভাবে নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে অন্তত ৭০টি ভেকু মেশিন বা এক্সকেভেটর এবং অন্তত দেড় হাজার শ্যালোর গাড়ি (স্টেয়ারিং)।
এধরণের গাড়িতে পথচারী, সড়কের ধারে বসবাসকারীর পাশাপাশি গাড়ির চালক-শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক হোসেন ইমামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, জনসাধারণের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতো আছেই, পাশাপাশি চালকের চেম্বারের ভাইব্রেশন, হিট, শব্দ ও রাসায়নিক মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে দেহের সকল মূল অর্গান সহ সারাদেহে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে, চালক-শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহ বলা চলে, কার্সিনোজেনিক ইফেক্টে ক্যান্সারের ঝুঁকিও রয়েছে। স্বাভাবিক বয়সের তুলনায় স্বাস্থ্য দ্রুত বৃদ্ধ হবে। বয়সের তুলনায় রোজগারের সক্ষমতা কমে আসবে।
দীর্ঘ দিন চলে আসা ভয়ংকর এক রীতি এভাবেই চলবে! না-কি খবর হবে সুখবর! এমন প্রশ্ন ছিলো কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনে। জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান জানান, এটা সারাদেশে অবৈধ ভাবে চলছে। জিরো টলারেন্সে নেয়া কঠিন ব্যপার। কোনো এলাকাবাসী লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা সেটার ব্যবস্থা নেব। তবে, জেলা জুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ডিসি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, নানা উপায়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের লাভের মাত্রা বাড়াতে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত এসব মনগড়া গাড়ি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে। জেলায় নিয়মিত খবর প্রকাশ এমনকি প্রতিবাদ কর্মসূচী হলেও কোনো প্রতিকার আসেনি। এ যেন এক দুষ্টু চক্রে ঘুরেফিরে আসা মরণফাঁদ।