ঢাকা ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষকের দৌরাত্ম্য থামবে কোথায়? দেশ কি তবে ধর্ষণনগরী?

শিবলী মাহাদী, লেখক ও কলামিষ্ট
  • আপডেট সময় : ০১:০৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫ ৪৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক মিরর টাইমস অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

‘ধর্ষণ’ দিন দিন শব্দটা আমাদের সাথে নিত্যদিনের সংবাদে পরিণত হচ্ছে। পত্রিকার পাতা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ মেলাতেই চতুর্দিকে শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষীতার আত্মচিৎকার শুনতে পাওয়া যায়! প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, ধর্ষণ কিন্তু হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পায়নি।

 

বরং এখন যেমনভাবে চলছে পূর্বেও একই কায়দায় চলেছে। পার্থক্য হলো পূর্বে ধর্ষণ এর সংবাদ প্রচার হতোনা আর এখন প্রচার হচ্ছে। ধর্ষণ ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলার প্রথম দ্বায় আমি মিডিয়া কে দিতে চাই! মিডিয়া এখন এমন এক যন্ত্র তারা শুধুই Public interest নিয়ে কাজ করে। কিন্তু Media এর সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা হলো।Moral Duties and Humanity! যার কারণে মিডিয়াকে বলা হতো Social Mirror! মিডিয়া Public interest নিয়ে কাজ করায় সমাজের দুষিত সংবাদগুলো Highlight হয়না। Media একেক সময় একেক বিষয় নিয়ে মেতে থাকে যেটা Public গ্রহণ করে।

 

অর্থাৎ মিডিয়া এখন জনসাধারণের চলমান রুচি মোতাবেক চলার চেষ্টা করে কিন্তু মিডিয়ার দায়িত্ব হলো জনসাধারণের রুচিবোধের পরিবর্তন করা অর্থাৎ জনগণের দৃষ্টি যেদিকে নেই সেদিকে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।এখন যেভাবে মিডিয়া ধর্ষণ এর সংবাদগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে এভাবে চলতে থাকলে জনরোষ ও জনবিস্ফোরণে ধর্ষকের কবর রচিত হবে। সুতরাং মিডিয়ার প্রতি অনুরোধ থাকবে তাদের Professional Responsibility এর জায়গা থেকে সমাজের এই দূষিত অপরাধ নিয়ে সর্বদা সজাগ থাকে।

 

ধর্ষকের শেষ বিজ এর পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়া কে এই দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি দ্বিতীয়ত দ্বায় করবো আমাদের সামাজিক বা গ্রাম আদালত কে। আমাদের দেশে গ্রাম্য শালিস বা উঠান শালিস ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দ্বায়ী। কারণ গ্রাম্য শালিস এর মাধ্যমে খুব সহজেই ধর্ষক নামকাওয়াস্তা শাস্তিতেই মুক্তি পেয়ে যায়। চলেন আমরা একটা পরিসংখ্যান দেখে আসি, বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইন ও বিচারবহির্ভূত সালিসে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি।

 

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি সালিস হয়েছে ধর্ষণের ঘটনায়।গ্রাম্য শালিসে একজন ধর্ষকের কেমন ধরনের শাস্তি হচ্ছে চলেন আমরা দেখে আসি,

 

১. গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে প্রতিবেশী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। পরে সালিস বসে। অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ‘জরিমানা’ আদায় করা হয়।

 

২.  ঢাকার ধামরাইয়ে গত ৭ ডিসেম্বর সেখানকার এক পোশাকশ্রমিক দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনা সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা হয় ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে।

 

৩. গত ৫ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে (৮) ধর্ষণের অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয় সালিসে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও চড়থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

 

৪.লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে রাকিব হোসেন নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে প্রেমিকাকে (১৬) ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার পর সালিসি বৈঠক হলেও বিচারে ভুক্তভোগী নারীকেই দোষী বানানো হয় ফলে মানসিক চাপে কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।

৫.ঢাকার নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কান্তারটেক গ্রামে দরিদ্র্য পরিবারের এক যুবতীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গ্রাম্য সালিশে সমাজপতিরা দশ হাজার টাকা জরিমানা করে এমন শতো সহস্র ধর্ষণের বিচার এভাবেই চলছে আমাদের গ্রাম্য শালিস ব্যবস্থায়।

 

বিচারে সন্তষ্ট হতে না পেরে ধর্ষিতা কোথাও আত্মহত্যা করছে, কোথাও নিরুদ্দেশ হচ্ছে। আপনাদের কে আরো ভয়ানক একটি তথ্য দেই। সরকারি-বেসরকারি ২০৬টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম জাতীয় শিশুকন্যা অ্যাডভোকেসি ফোরাম বলছে, তারা ২৪টি জাতীয় দৈনিক, ৪৫টি স্থানীয় দৈনিক ও ৫টি অনলাইন গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৮ মাসে মোট ২২৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এমনকি এক বছর বয়সের শিশুরাও এই জঘন্যতম অপরাধের শিকার হয়েছে।এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী ৮১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো অধিকাংশই গ্রাম্য শালিসে সমাধান হয়ে গিয়েছে এবং অপরাধীরাও বুক ফুলিয়ে চলে বেড়াচ্ছে।

 

কিন্তু ধর্ষণের বিচার কি গ্রাম্য শালিসে বৈধ? চলেন দেখে আসি আইন কি বলে, “ধর্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। এটা এতটাই গুরুতর অপরাধ যে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে এবং শাস্তি হতে হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এ ধরনের অপরাধ মীমাংসা করা বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার সালিসকারীদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালিসে ধর্ষণের বিচারের রায় নারীর বিপক্ষে যায়” সুতরাং গ্রাম্য শালিসে ধর্ষণের বিচার করা যাবেনা।

 

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কে এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে আইন তৈরি করে গ্রাম্য শালিস নিষিদ্ধ এবং শালিসীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি তৃতীয়ত দ্বায় দিতে চাই আমাদের সমাজ কে আমাদের চিন্তাচেতনা কে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয়েও আইনের দ্বারস্থ হয়না মান সম্মানের ভয়ে। সমাজের মানুষের সামনে অপদস্ত হওয়ার ভয়ে অনেকেই নিরব থাকে।

 

 

আমাদেরকে বুঝতে হবে, ধর্ষিতা কোনো অপরাধী নয় বরং সে নির্যাতনের শিকার। তাকে সহানুভূতি দেখানো, তাকে সাহস দেওয়া ,তার দেখাশোনা করা আমাদের দায়িত্ব। সেটা না করে আমরা ধর্ষিতা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাই, হেয় প্রতিপন্ন করি। বরং সমাজের লজ্জা পাওয়া উচিত কারণ তারা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারেনাই। যেখানে ধর্ষকের সমাজত্যাগ করার কথা সেখানে দুঃখজনকভাবে ধর্ষিতা সমাজ ত্যাগ করে।

 

এই বিষয়ে মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিক্ষক ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি কে এগিয়ে আসতে হবে। কোনো মানুষ যদি ধর্ষিতা কে অপমাণ করে তবে তাকে ধর্ষণকান্ডে সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা সমাজ যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকি তবেই সমাজ দূষণমুক্ত হবে। ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি চতুর্থত দ্বায়ী করতে চাই আমাদের দেশের চলমান আইন প্রকৃয়া কে। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যেটি তদন্ত করতে এবং প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় লাগেনা।

 

সুতরাং দ্রুত বিচার আইনে ধর্ষকের বিচার করতে হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু আসামীর শাস্তি জনসম্মুখে প্রকাশ্যে দেওয়া হউক যাতে করে বাকিরা সাবধান হয়ে যায়। আমাদের দেশের ধর্ষণের বিচার প্রকৃয়া ধীরগতির। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৬ মার্চ পর্যন্ত এ আইনে মামলা হয়েছে ৯৫৩টি।

 

এর মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৩৭৬টি মামলার। এছাড়া তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৩৫৪টি। কিছু মামলা ৫ বছর পর্যন্ত ঝুলে।আছে যেখানে ১৮০ দিনের ভেতর মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। সুতরাং বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে ধর্ষণের মামলা নিষ্পত্তি করতে।হবে।

 

ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি পঞ্চমত দ্বায়ি করতে চাই মেয়েদের অসাবধানাবশত চলাফেরা কে। আমাদের সমাজ এখনো নারীবান্ধব সমাজ হয়ে উঠেনি। সুতরাং আমাদের মেয়েদের শালীন পোষাক ও চলাফেরা মেলামেশায় সতর্ক থাকা উচিত। ইসলাম সেক্ষেত্রে অনেক সুন্দর সমাধান দিয়েছে।

 

যারা মুসলমান তারা ইসলামে নারীদের যে পোশাকের কথা বলা আছে সে মোতাবেক চলতে পারে। তাহলেও ধর্ষণ এর পরিমাণ বহু শতাংশ কমে আসবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন , “মুমিনদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টির সংযম রাখে এবং নিজেদের চিত্তকে সংযত রাখে। (সুরা নূর, ২৪:৩০)।

 

ধর্ষণের জন্য আমি সর্বশেষ দ্বায়ি করতে চাই বাল্যবিবাহ আইন কে। আমি জানি আপনারা অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। কিন্তু এটি একটি অন্যতম কারণ। ছেলে মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক (ইসলামের ভাষায় বালেগ) হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া উত্তম। সেক্ষেত্রে সরকার ছেলে মেয়েদের বিবাহের বয়স ১৮-২১ থেকে কমিয়ে ১৫-১৮ করতে পারে।

 

সর্বপোরী একটি কথাই বলে শেষ করতে চাই সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ ও গণআন্দোলন পারে ধর্ষণের এই দৌরাত্ম্য থামাতে ধর্ষক কে দেখামাত্রই আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে জীবিত তুলে দিন।ঢাল না হয়ে তলোয়ার হয়ে উঠুন। ধর্ষণ নিভে যাবে ইনশাআল্লাহ।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

ধর্ষকের দৌরাত্ম্য থামবে কোথায়? দেশ কি তবে ধর্ষণনগরী?

আপডেট সময় : ০১:০৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫

‘ধর্ষণ’ দিন দিন শব্দটা আমাদের সাথে নিত্যদিনের সংবাদে পরিণত হচ্ছে। পত্রিকার পাতা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ মেলাতেই চতুর্দিকে শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষীতার আত্মচিৎকার শুনতে পাওয়া যায়! প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, ধর্ষণ কিন্তু হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পায়নি।

 

বরং এখন যেমনভাবে চলছে পূর্বেও একই কায়দায় চলেছে। পার্থক্য হলো পূর্বে ধর্ষণ এর সংবাদ প্রচার হতোনা আর এখন প্রচার হচ্ছে। ধর্ষণ ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলার প্রথম দ্বায় আমি মিডিয়া কে দিতে চাই! মিডিয়া এখন এমন এক যন্ত্র তারা শুধুই Public interest নিয়ে কাজ করে। কিন্তু Media এর সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা হলো।Moral Duties and Humanity! যার কারণে মিডিয়াকে বলা হতো Social Mirror! মিডিয়া Public interest নিয়ে কাজ করায় সমাজের দুষিত সংবাদগুলো Highlight হয়না। Media একেক সময় একেক বিষয় নিয়ে মেতে থাকে যেটা Public গ্রহণ করে।

 

অর্থাৎ মিডিয়া এখন জনসাধারণের চলমান রুচি মোতাবেক চলার চেষ্টা করে কিন্তু মিডিয়ার দায়িত্ব হলো জনসাধারণের রুচিবোধের পরিবর্তন করা অর্থাৎ জনগণের দৃষ্টি যেদিকে নেই সেদিকে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।এখন যেভাবে মিডিয়া ধর্ষণ এর সংবাদগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে এভাবে চলতে থাকলে জনরোষ ও জনবিস্ফোরণে ধর্ষকের কবর রচিত হবে। সুতরাং মিডিয়ার প্রতি অনুরোধ থাকবে তাদের Professional Responsibility এর জায়গা থেকে সমাজের এই দূষিত অপরাধ নিয়ে সর্বদা সজাগ থাকে।

 

ধর্ষকের শেষ বিজ এর পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়া কে এই দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি দ্বিতীয়ত দ্বায় করবো আমাদের সামাজিক বা গ্রাম আদালত কে। আমাদের দেশে গ্রাম্য শালিস বা উঠান শালিস ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দ্বায়ী। কারণ গ্রাম্য শালিস এর মাধ্যমে খুব সহজেই ধর্ষক নামকাওয়াস্তা শাস্তিতেই মুক্তি পেয়ে যায়। চলেন আমরা একটা পরিসংখ্যান দেখে আসি, বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইন ও বিচারবহির্ভূত সালিসে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি।

 

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি সালিস হয়েছে ধর্ষণের ঘটনায়।গ্রাম্য শালিসে একজন ধর্ষকের কেমন ধরনের শাস্তি হচ্ছে চলেন আমরা দেখে আসি,

 

১. গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে প্রতিবেশী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। পরে সালিস বসে। অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ‘জরিমানা’ আদায় করা হয়।

 

২.  ঢাকার ধামরাইয়ে গত ৭ ডিসেম্বর সেখানকার এক পোশাকশ্রমিক দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনা সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা হয় ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে।

 

৩. গত ৫ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে (৮) ধর্ষণের অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয় সালিসে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও চড়থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

 

৪.লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে রাকিব হোসেন নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে প্রেমিকাকে (১৬) ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার পর সালিসি বৈঠক হলেও বিচারে ভুক্তভোগী নারীকেই দোষী বানানো হয় ফলে মানসিক চাপে কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।

৫.ঢাকার নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কান্তারটেক গ্রামে দরিদ্র্য পরিবারের এক যুবতীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গ্রাম্য সালিশে সমাজপতিরা দশ হাজার টাকা জরিমানা করে এমন শতো সহস্র ধর্ষণের বিচার এভাবেই চলছে আমাদের গ্রাম্য শালিস ব্যবস্থায়।

 

বিচারে সন্তষ্ট হতে না পেরে ধর্ষিতা কোথাও আত্মহত্যা করছে, কোথাও নিরুদ্দেশ হচ্ছে। আপনাদের কে আরো ভয়ানক একটি তথ্য দেই। সরকারি-বেসরকারি ২০৬টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম জাতীয় শিশুকন্যা অ্যাডভোকেসি ফোরাম বলছে, তারা ২৪টি জাতীয় দৈনিক, ৪৫টি স্থানীয় দৈনিক ও ৫টি অনলাইন গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৮ মাসে মোট ২২৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এমনকি এক বছর বয়সের শিশুরাও এই জঘন্যতম অপরাধের শিকার হয়েছে।এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী ৮১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো অধিকাংশই গ্রাম্য শালিসে সমাধান হয়ে গিয়েছে এবং অপরাধীরাও বুক ফুলিয়ে চলে বেড়াচ্ছে।

 

কিন্তু ধর্ষণের বিচার কি গ্রাম্য শালিসে বৈধ? চলেন দেখে আসি আইন কি বলে, “ধর্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। এটা এতটাই গুরুতর অপরাধ যে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে এবং শাস্তি হতে হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এ ধরনের অপরাধ মীমাংসা করা বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার সালিসকারীদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালিসে ধর্ষণের বিচারের রায় নারীর বিপক্ষে যায়” সুতরাং গ্রাম্য শালিসে ধর্ষণের বিচার করা যাবেনা।

 

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কে এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে আইন তৈরি করে গ্রাম্য শালিস নিষিদ্ধ এবং শালিসীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি তৃতীয়ত দ্বায় দিতে চাই আমাদের সমাজ কে আমাদের চিন্তাচেতনা কে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয়েও আইনের দ্বারস্থ হয়না মান সম্মানের ভয়ে। সমাজের মানুষের সামনে অপদস্ত হওয়ার ভয়ে অনেকেই নিরব থাকে।

 

 

আমাদেরকে বুঝতে হবে, ধর্ষিতা কোনো অপরাধী নয় বরং সে নির্যাতনের শিকার। তাকে সহানুভূতি দেখানো, তাকে সাহস দেওয়া ,তার দেখাশোনা করা আমাদের দায়িত্ব। সেটা না করে আমরা ধর্ষিতা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাই, হেয় প্রতিপন্ন করি। বরং সমাজের লজ্জা পাওয়া উচিত কারণ তারা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারেনাই। যেখানে ধর্ষকের সমাজত্যাগ করার কথা সেখানে দুঃখজনকভাবে ধর্ষিতা সমাজ ত্যাগ করে।

 

এই বিষয়ে মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিক্ষক ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি কে এগিয়ে আসতে হবে। কোনো মানুষ যদি ধর্ষিতা কে অপমাণ করে তবে তাকে ধর্ষণকান্ডে সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা সমাজ যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকি তবেই সমাজ দূষণমুক্ত হবে। ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি চতুর্থত দ্বায়ী করতে চাই আমাদের দেশের চলমান আইন প্রকৃয়া কে। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যেটি তদন্ত করতে এবং প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় লাগেনা।

 

সুতরাং দ্রুত বিচার আইনে ধর্ষকের বিচার করতে হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু আসামীর শাস্তি জনসম্মুখে প্রকাশ্যে দেওয়া হউক যাতে করে বাকিরা সাবধান হয়ে যায়। আমাদের দেশের ধর্ষণের বিচার প্রকৃয়া ধীরগতির। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৬ মার্চ পর্যন্ত এ আইনে মামলা হয়েছে ৯৫৩টি।

 

এর মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৩৭৬টি মামলার। এছাড়া তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৩৫৪টি। কিছু মামলা ৫ বছর পর্যন্ত ঝুলে।আছে যেখানে ১৮০ দিনের ভেতর মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। সুতরাং বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে ধর্ষণের মামলা নিষ্পত্তি করতে।হবে।

 

ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য আমি পঞ্চমত দ্বায়ি করতে চাই মেয়েদের অসাবধানাবশত চলাফেরা কে। আমাদের সমাজ এখনো নারীবান্ধব সমাজ হয়ে উঠেনি। সুতরাং আমাদের মেয়েদের শালীন পোষাক ও চলাফেরা মেলামেশায় সতর্ক থাকা উচিত। ইসলাম সেক্ষেত্রে অনেক সুন্দর সমাধান দিয়েছে।

 

যারা মুসলমান তারা ইসলামে নারীদের যে পোশাকের কথা বলা আছে সে মোতাবেক চলতে পারে। তাহলেও ধর্ষণ এর পরিমাণ বহু শতাংশ কমে আসবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন , “মুমিনদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টির সংযম রাখে এবং নিজেদের চিত্তকে সংযত রাখে। (সুরা নূর, ২৪:৩০)।

 

ধর্ষণের জন্য আমি সর্বশেষ দ্বায়ি করতে চাই বাল্যবিবাহ আইন কে। আমি জানি আপনারা অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। কিন্তু এটি একটি অন্যতম কারণ। ছেলে মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক (ইসলামের ভাষায় বালেগ) হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া উত্তম। সেক্ষেত্রে সরকার ছেলে মেয়েদের বিবাহের বয়স ১৮-২১ থেকে কমিয়ে ১৫-১৮ করতে পারে।

 

সর্বপোরী একটি কথাই বলে শেষ করতে চাই সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ ও গণআন্দোলন পারে ধর্ষণের এই দৌরাত্ম্য থামাতে ধর্ষক কে দেখামাত্রই আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে জীবিত তুলে দিন।ঢাল না হয়ে তলোয়ার হয়ে উঠুন। ধর্ষণ নিভে যাবে ইনশাআল্লাহ।